শনিবার ● ২৫ জুন ২০২২
প্রচ্ছদ » ইতিহাস-ঐতিহ্য » পাকিস্তানি হানাদারের গণহত্যা নিয়ে নাটক ‘জাঠিভাঙ্গার মৃত্যু পুরাণ’
পাকিস্তানি হানাদারের গণহত্যা নিয়ে নাটক ‘জাঠিভাঙ্গার মৃত্যু পুরাণ’
গোলাম সারোয়ার সম্রাট, ঠাকুরগাঁও :
ঠাকুরগাঁওয়ের জাঠিভাঙ্গায় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘটে যাওয়া নারকীয় হত্যাকাণ্ডের উপর ভিত্তি করে সৈয়দ জাকির হোসেন ইমন রচিত ও নির্দেশিত পরিবেশ থিয়েটার ‘জাঠিভাঙ্গার মৃত্যুপুরাণ’ গত ২৩ জুন বৃহস্পতিবার রাতে সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ইউপির জাঠিভাঙ্গা বধ্যভূমি চত্বরে মঞ্চস্থ হয়। মুজিব শতবর্ষ ও স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী উদযাপন উপলক্ষে নাটকের আয়োজন করা হয়। জেলা শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ও রেপার্টরি নাট্যদলের পরিবেশনায় জেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় নাটক শেষে আলোচনায় অংশ নেন,জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান, পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন,জেলা সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. বদরুদ্দোজা বদর। এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক সহধর্মিনী জান্নাতুল ফেরদৌসী,এনএসআই’র জয়েন্ট ডিরেক্টর হেমায়েত হোসেন,সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার আবু তাহের মো. সামসুজ্জামান,জেলা আ’লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাম্মেল হক, ঠাকুরগাঁও প্রেস ক্লাবের সভাপতি মনসুর আলী, নাট্যকার ও নির্দেশক সৈয়দ জাকির হোসেন ইমন,শুখানপুকুরী ইউপি চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান প্রমুখ।
জাঠিভাঙ্গায় পাকিস্তানি হানাদারের গণহত্যার ইতিহাস ছিল অত্যন্ত বেদনাবিধুর। ঠাকুরগাঁও সদরের বালিয়া ইউনিয়নের কিসমত সুকানপুকুরী মৌজার জাঠিভাঙ্গায় ৭১ এর ২৩ এপ্রিল প্রায় আড়াই হাজার মানুষকে হত্যা করে পাকি সেনা ও তাদের নরপশু দোসররা। স্বাধীনতা ঘোষণার পর রাজাকার, আলবদর ও আল-শামসের সহায়তায় হানাদাররা মুক্তিকামী জনগণের ওপর অমানবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে শুরু করে। এ নির্যাতন থেকে বাঁচতে ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়া, শুখানপুকুরী, জগন্নাথপুর, চকহলদি, সিংগিয়া, চন্ডীপুর, বাসুদেবপুর, মিলনপুর, গৌরীপুর, খামার ভোপলা, দিনাজপুরের বীরগঞ্জের পলাশবাড়ী ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার হিন্দু সম্প্রদায়ের পরিবার স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে থাকে। ওই দিন কৌশলে তাদের জাঠিভাঙ্গা নদীর পাড়ে জড়ো করে পাকি হানাদারের দোসররা। রাজাকাররা খবর দিলে হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে সব নারী-পুরুষকে ঘিরে ফেলে। এরপর গুলি আর ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রায় আড়াই হাজার পুরুষকে হত্যা করে ফেলে দেওয়া হয় নদীতে।
একদিনেই প্রায় আড়াইশ মহিলা বিধবা হয়।পরে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ তৈরি করা হয়েছে। নাটকে ১৯৭১ সালে ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার শুখানপুকুরী ইউনিয়নের জাঠিভাঙ্গায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার বিভিন্ন বিষয় ফুটে উঠে। রচনা ও নির্দেশনা সৈয়দ জাকির হোসেন ইমনের পাশাপাশি সার্বিক তত্বাধানে ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. মাহবুবুর রহমান। বিশেষ সহায়তায় ছিলেন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মামুন ভুঁইয়া। সার্বিক
ব্যবস্থাপনা ও সঙ্গীত পরিকল্পনায় ছিলেন শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক পার্থ সারথী দাস।
পরিবেশ থিয়েটার:
পরিবেশ সংক্রান্ত নাটক বিভিন্ন বিষয় এবং প্রেক্ষিত নিয়ে উপস্থাপন করা সম্ভব। যেমন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধোত্তর জীবন জটিলতা অতিক্রমের জন্যই আবশ্যক হয়ে পড়ে নতুন আঙ্গিক ও উপস্থাপনরীতি।
রিচার্ড শেফনার ইনভাইরনমেন্টাল থিয়েটার বা পরিবেশ নাটক বলতে যা বুঝিয়েছিলেন তাতে গড়পড়তায় দাঁড়ায় যে প্রচলিত প্রেক্ষাগৃহের বা মঞ্চের বাইরে অন্যত্র নাটক মঞ্চায়ন।
এ পদ্ধতিতে যেকোনো স্থানে নাটক মঞ্চায়ন উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে নাট্য পরিবেশনা সম্ভব। এর সাফল্য পুরোমাত্রায় নির্ভর করে টীমওয়ার্ক,নাট্যকর্মীদের কর্মতৎপরতার সমন্বয় ও যথাযথ গবেষণার উপর। যেটা অনেকাংশেই বাস্তায়ন করতে পেরেছেন নাটক ‘জাঠিভাঙ্গার মৃত্যু পুরাণ’-এ নাট্যকার-নির্দেশক সৈয়দ জাকির হোসেন ইমন। নাটকটির নির্দেশনা,গবেষণা,অভিনয় ও নাট্যরীতিতে বিভিন্ন মেধার সমন্বয়ে ‘জাঠিভাঙ্গার মৃত্যু পুরাণ’ এর রূপকল্প নির্মাণকে অনেকাংশেই উত্তীর্ণ বলা যেতে পারে। নাটকটিতে ব্যবহৃত কোরিওগ্রাফি ছিল মানসম্পন্ন। তবে প্রি রেকর্ডেট সংলাপ নতুন হলেও এটি নিয়ে আরো নীরিক্ষা করা যেতে পারে। শিল্পীদের সবার পারপরমেনস্ মোটা দাগে ভালো মনে হয়েছে। কারণ প্রায় শতাধিক কুশিলব মনে প্রাণে অভিনয় করেছেন সবাই কাহিনি ও হত্যাযজ্ঞের নির্মমতার আবেগে আক্রান্ত ছিলেন। আবহ সংগীত ভালো হয়েছে। কোরিওগ্রাফি শিল্পীরা ভালো করেছেন। আমার জানা মতে অভিনেতাদের মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের বেশ কয়েকটি প্রাচীন নাট্যসংগঠনের শিল্পীরা অভিনয় করেছে, তাঁরা প্রত্যেকেই ভালো করেছেন। আগামীতে তাঁদের অভিনয় দেখবার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। তবে এই ধরনের নাটকে ইমপ্রভাইজেশানের কোন লিমিটেশন থাকেনা। দেখা যাক পরে কোন মঞ্চে নির্দেশকের চিন্তার রকমফের।
পরিবেশ থিয়েটারে একটি সুনির্দিষ্ট স্থানের ঐতিহাসিক ও নৃতাত্ত্বিক ঘটনা,চরিত্রসমূহকে সমকালীন প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে নাট্যক্রিয়া নির্মাণ করা হয় । সে হিসেবে এটি অনেকাংশেই ভালো প্রোডাক্টশন হয়েছে। অভিনয় শিল্পীদের,নাটকের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পী, কারিগর,বাচিক শিল্পীসহ কারো নাম উল্লেখ করলাম না। আগামী প্রোডাকশনে নিশ্চয় আরো ব্যাপক পরিসরে লেখা সম্ভব হবে।