বৃহস্পতিবার ● ১৭ জুন ২০২১
প্রচ্ছদ » উন্নয়ন-সম্ভাবনা » ঠাকুরগাঁওয়ে “শিশু বিবাহ প্রতিরোধ শীর্ষক” গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত
ঠাকুরগাঁওয়ে “শিশু বিবাহ প্রতিরোধ শীর্ষক” গোল টেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত
দেশায়ন ডেস্ক : মেয়ে শিশুর সব থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে শিশুবিাবহ। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৫১ ভাগ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। করোনাকালে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি জনসচেতনতা, প্রচলিত আইনের প্রয়োগ এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সু-সমন্বয় বৃদ্বি পেলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।
এমন ধারণা থেকে ও “আমিই পারি শিশু বিবাহ প্রতিরোধ করতে” এই শ্লোগানকে সামনে রেখে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, ঠাকুরগাঁও শাখার আয়োজনে ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ এর জেলা প্রতিনিধি ও দৈনিক সংগ্রামী বাংলা সম্পাদক ও ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের জেষ্ঠ সাংবাদিক মো: আব্দুল লতিফের সভাপতিত্বে “শিশু বিবাহ প্রতিরোধ শীর্ষক এক গোল টেবিল বৈঠক” ঠাকুরগাঁও প্রেসক্লাবের আনিসুল হক মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, ঠাকুরগাঁও শাখার এপি ম্যানেজার লিওবার্ট চিসিম এর সঞ্চালনায় গোল টেবিল বৈঠকের আলোচনায় বক্তব্য ও সুপারিশমালা প্রদান করেন ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এডভোকেসী কো-অর্ডিনেটর মো: তানজিমুল ইসলাম, প্রেসক্লাবের সহ-সভাপতি ও এস এ টিভি এবং যায়াদিন প্রতিনিধি জাকির মোস্তাফিজ মিলু, দৈনিক খবর ও ইনডিপেনডেন্ট এর জেলা প্রতিনদধি শাহীন ফেরদৌস, প্রেসকাবের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও এটিন বাংলার জেলা প্রতিনিধি ফিরোজ আমিন সরকার, দৈনিক জনকণ্ঠ ও একুশে টিভির জেলা প্রতিনিধি এস এম জসিম উদ্দিন, দৈনিক সময়ের আলোর জেলা প্রতিনিধি শাহ্ মো: নাজমুল ইসলাম ও দৈনিক লাখো কণ্ঠের জেলা প্রতিনিধি রেজওয়ানুল হক বিজু সহ বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ।
বক্তাগণ এসময় শিশু বিবাহের নানাবিধ কারণ উপস্থান করেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- দারিদ্র্য, কম বয়সে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেওয়ার প্রচলিত সামাজিক প্রথা, যৌতুক প্রথা, মেয়ে শিশুর সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অজ্ঞতা, পারিবারিক ওয়াদা পূরণ, সচেতনতার অভাব, কুসংস্কার, সামাজিক অস্থিরতা, মেয়েশিশুদের বোঝা মনে করা, শিশুবিবাহ নিরোধ আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া ইত্যাদি।
ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের এডভোকেশী কো অর্ডিনেটর মো: তানজিমুল ইসলাম বলেন, ১৯৭২ থেকে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশে কাজ করছে। বর্তমানে আমরা দেশের ২৮ জেলার ৫৫ টি উপজেলায় কাজ করছি। আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে শিশু সুরা। শিশুরা যেন তাদের অধিকার পায়, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। জীবন দতার উন্নয়ন হয়, এ ল্েয আমরা কাজ করি। গার্লস নট ব্রাইডের এক গবেষণায় এসেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ শিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়। প্রতি মিনিটে ২২ জন মেয়ে শিশুবিবাহের শিকার হচ্ছে। ইউনিসেফের এক তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ২১ শতাংশ কিশোরীর বিয়ে হয়েছে ১৮ বছরের আগে, যাঁদের বয়স এখন ২০ থেকে ২৪ বছর। এই ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে ২০৩০ সালের মধ্যে ১০ কোটি ১০ লাখের বেশি কিশোরীর শিশুবিবাহ হয়ে যেতে পারে।
গত এক বছরে ওয়ার্ল্ড ভিশন যে ৫৫টি উপজেলায় কাজ করছে, সেখানে আমাদের তথ্য অনুযায়ী ৪৮৬টি শিশুর বিবাহ হয়েছে। এক বছর আগে এ সংখ্যা ছিল ১৫৯। সে হিসেবে কোভিডের সময় বাল্যবিবাহ প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। দারিদ্র্য, যৌন হয়রানি, নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে বলে অভিভাবকেরা জানিয়েছেন। তবে আমরা মনে করি, এসবই একমাত্র কারণ নয়। শিশুবিবাহ আমাদের একটা সংস্কৃতিতেও পরিণত হয়েছে বলে মনে করি।
আমরা ওয়ার্ল্ড ভিশনের প থেকে সবাইকে বলতে চাই, মেয়ের যেন ১৮ বছরের আগে বিয়ে না হয়। আমরা যদি স্কুলে যাওয়া নিশ্চিত করতে পারি, কিশোরীদের মতায়ন করতে পারি, সামাজিক নিরাপত্তার আওতা বাড়ান যায়, স্থানীয় সরকারকে আরও বেশি কার্যকর করতে পারি, তাহলে শিশুবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।
প্রেসক্লাবের সহ সভাপতি ও এস এ টিভি এবং যায়াদিনের সাংবাদিক জাকির মোস্তাফিজ মিলু বলেন, শিশুবিবাহের জন্য আমরা সমাজ ও পরিবারকে দোষারোপ করে থাকি। কিন্তু সেই সমাজ ও পরিবার তো আমরাই। কেবল আমরা সচেতন হলেই শিশুবিবাহ বন্ধ হবে।
দৈনিক সময়ের আলোর জেলা প্রতিনিধি শাহ্ মো: নাজমুল ইসলাম বলেন, প্রায় শত বছর আগে, ১৯২৯ সালে বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন তৈরি করা হয়েছিল, আবার ২০১৭ সালে পাস হয়েছে চাইল্ড ম্যারেজ অ্যাক্ট। অর্থাৎ এক শ বছর আগেও সমস্যা ছিল, সেটা এখনো আছে। এখনো ৫১ দশমিক ৪০ শতাংশ চাইল্ড ম্যারেজ বাংলাদেশে হচ্ছে। ২০১৩ সালে এটা ছিল ৫২ দশমিক ৪০ শতাংশ। এত বছরে আমরা মাত্র ১ শতাংশ কমাতে পেরেছি। তবে ১৯৭১ সালে ৯০ শতাংশ শিশুবিবাহ ছিল। অনেক েেত্র আমরা এগিয়েছি। কিন্তু বাল্যবিবাহ রোধের েেত্র এগোতে পারিনি। আমরা অনেকে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছি কিন্তু আশানুরূপ ফল পাচ্ছি না। এ েেত্র আমাদের সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে, তা না হলে কাঙ্তি ফল পাব না।
দৈনিক খবর পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি শাহীন ফেরদৌস বলেন, জাতীয় কর্মপরিকল্পনা, উন্নয়ন সহযোগী প্রতিষ্ঠান ও গণমাধ্যমেই আমরা বাল্যবিবাহ কমাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন বাজেট বরাদ্দ। ঘরে বন্দী থেকে প্রায় অধিকাংশ মেয়ে মানসিকভাবে ভালো নেই। তাদের মেন্টাল হেলথ সেবা দিতে হবে। ডিজিটালি পড়ালেখার পাশাপাশি যেন তাদের ডিজিটালি সুস্থ বিনোদনের সুযোগ থাকে, সেটাও ভাবতে হবে।
দেনিক জনকণ্ঠ ও একুশে টিভির জেলা প্রতিনিধি এস এম জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের যদি দৃঢ় অঙ্গীকার থাকে, দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা যদি দায়িত্ব পালন করেন, সর্বোপরি পরিবার যদি কন্যাশিশুর উজ্জ্বল ভবিষ্যতের কথা ভাবে, তাহলে বাল্যবিবাহ বন্ধ হবে। মেয়েশিশুর সব থেকে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে শিশুবিাবহ। ১৮ বছর বয়স হওয়ার আগেই ৫১ ভাগ মেয়ের বিয়ে হচ্ছে। করোনাকালে এই পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি অভিভাবকদের সচেতনতা, আইনের প্রয়োগ, নজরদারি এবং সরকারি-বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো গেলে দেশ থেকে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব।
প্রেসক্লাবের সহ-সাধারণ সম্পাদক ও এটিন বাংলার জেলা প্রতিনিধি ফিরোজ আমিন সরকার বলেন, অভিভাবক বাল্যবিবাহের তিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নন। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের জন্য সরকারের প থেকে ভাতার ব্যবস্থা এবং বখাটেদের উৎপাত বন্ধের জন্য স্থানীয় সরকারের প থেকে সামাজিক উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। বাল্যবিবাহের েেত্র যদি আমরা জিরো টলারেন্স না নিই, তাহলে এটা রোধ করতে পারব না।
বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা বিশেষ করে শিশুদের জোরপূর্বক বিয়ে দেওয়া এবং শিশুদের প্রতি যৌন সহিংসতা উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে সকল প্রকার সহিংসতা, যৌন হয়রানী ও শিশুবিবাহ প্রতিরোধে বিভিন্ন সুপারিশমালা উঠে আসে এ গোল টেবিল বৈঠকে।