বুধবার ● ১০ জুন ২০২০
প্রচ্ছদ » আন্তর্জাতিক » গ্যাংটক থেকে ইয়ামথাং ভ্রমণ : আফরোজা রিকা
গ্যাংটক থেকে ইয়ামথাং ভ্রমণ : আফরোজা রিকা
মন সরোবরে কোরালের খেলা: সেন্ট্রোল সাইবেরিয়ার ছোট্ট নগর অয়মিয়াকনে পৌঁছে গেছি। ভীষণ ক্ষুধার্ত। তাপমাত্রা মাইনাস ৬৭.০৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কী সাংঘাতিক! বাংলাদেশে একটি ডিপ ফ্রিজে মাইনাস ১৮ থেকে ২০ ডিগ্সেরি সেলসিয়াস থাকে। সঙ্গে যা খাবার ছিল সব বরফে জমে পাথর হয়েছে। আপেল জমে এমন পাথর হয়েছে যে, ছোট ছেলে গাড়ির কাঁচে জোড়ে জোড়ে হাতুড়ির মত আঘাত করছে। তবু জানালা থেকে বরফ সরানো যাচ্ছে না। এখানে এখনো এক হাজার মানুষ স্যামন, হরিণ আর ঘোড়ার মাংস খেয়ে বেঁচে আছে? আশ্চর্য! আমরা বরফে জমে কাঁপবার শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। আমার মনে হচ্ছে আমরা বেঁচে নেই। আমাদের আত্মাগুলো মরা শরীর নিয়ে পৌঁছেছে এই শীতল নগরে। তবু একবার পরীক্ষা করার জন্য সমস্বরে চিৎকার করছি, ডাকছি-‘কেউ কী আছেন? আমাদের উদ্ধার করুন। জানিনা আমরা কেমন করে এখানে পৌঁছে গেছি, কেউ কি শুনছেন?’ বারবার ডাকছি।
বড় ছেলে শরীরে ধাক্কা দিচ্ছে,-এ্যাই আম্মু ! কী হয়েছে, গোঙাচ্ছ কেন?
: আমরা বেঁচে আছি?
: কী বলছ?
: না, মানে অয়মিয়াকনে বরফে জমে যাইনি?
: অয়মিয়াকনে যাব কেন? আমরাতো সিকিম যাব আজকে। সকালেই গাড়ি আসবে,এখন ভোর ছ’টা,এলার্ম বাজছে। ওঠো জলদি, রেডি হতে হবে-বলেই সবাইকে ডেকে দিল। : ও অল্লাহ! আমি তাহলে স্বপ্ন দেখছিলাম। তাইতো অয়মিয়াকনে যাব কেন? আমরাতো সিকিমে যাব,প্রস্তুতি নিয়েছি। ও হ্যাঁ মনে পড়েছে, সত্যিই সত্যিই বরফের পাহাড় দেখব,বরফের রাস্তাগুলো কেমন হয় তাই জানতে এক্সাইটিং হয়ে গত রাতে ঘুমোনোর আগে অয়মিয়াকনের ভিডিওটা দেখেছি। সেখান থেকেই এই দু:স্বপ্নের জন্ম। নাহ, সিকিম আর অয়মিয়াকনের অনেক পার্থক্য। অয়মিয়াকন হচ্ছে দ্য কোল্ডেস্ট টাউন অন আর্থ। আর সিকিমে সাঙ্গু এবং ইয়ামথাং ভ্যালিতে যথেষ্ট বরফ আছে তবে তাপমাত্রা অত কম নয়, সহনীয়।
আজ পহেলা এপ্রিল ২০১৯। আর দুদিন পরেই সত্যিই সেই বরফ দেখব, দুহাত দিয়ে ছোঁব,আইসবল বানাবো,বরফের সমুদ্রে সাঁতার কাটব! কেমন যেন শিশুর মত হয়ে যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি তৈরি হলাম,আমরা চারজন। আমি, আমার দুই ছেলে আর আমার হাসব্যান্ড। আমরা বাংলাবান্ধা বর্ডার হয়ে শিলিগুড়ি দিয়ে সিকিম পৌঁছাব। ঢাকা থেকে যেতে হলে চ্যাংড়াবান্ধা-বুড়িমারি বর্ডার থেকে শিলিগুড়ি খুব সহজেই যাওয়া যায়। শ্যামলী পরিবহনের বাস কল্যাণপুর থেকে যায়। বিমান মাধ্যমে যেতে চাইলে সিকিমের রাজধানী গ্যাংটকের কাছে একমাত্র পাকইয়োং বিমানবন্দর চালু হয়েছে,যা সবচেয়ে নিকটবর্তী। সেভাবে যাওয়া যায়। শিলিগুড়ি গিয়ে বিমান নিতে চাইলে বাগডোগড়া বিমানবন্দর রয়েছে। শিলিগুড়ি,দার্জিলিং বা কালিম্পং থেকেও ট্যাক্সি করে সিকিম পৌঁছানো যায়।
আমরা বাংলাদেশ ভারত উভয় ইমিগ্রেশনে যাবতীয় ফরমালিটিস শেষ করে বাংলাদেশি টাকাকে রুপি করে নিলাম। একশ টাকায় আশি রুপি পেলাম। এর পূর্বের ভ্রমণে বছরখানেক আগে একশ টাকায় চুরাশি রুপি পেয়েছিলাম। যা হোক,আমরা ০১-০৪-২০১৯ বেলা বারোটার মধ্যেই শিলিগুড়ি পৌঁছে গেলাম। এস এন টি বাসস্ট্যান্ডে দুপুরের ভাত-সব্জি খেয়ে শিলিগুড়ি থেকে সিকিমের গ্যাংটকে যাওয়ার গাড়ি ঠিক করলাম।
মাঝরাস্তায় পরিচ্ছন্ন আধুনিক হোটেল আছে। সেখানেও লাঞ্চের ব্যবস্থা রয়েছে। ড্রাইভার আধাঘন্টা ব্রেক দেয়, ওয়াশরুমে যাওয়ার,চা কফি,লাঞ্চের জন্য।
তিস্তার আঁচল ধরে গ্যাংটকের পথে:
শিলিগুড়ি এস এন টি স্ট্যান্ড থেকে বিভিন্নভাবে গ্যাংটক যাওয়া যায়। বাসে গেলে ভাড়া ১৫০ রুপি আর জিপে শেয়ারে গেলে ২৫০ রুপি,দশজনের সিট খুব চাপাচাপি হয়। আমরা আরাম চাইছিলাম। ট্যাক্সিতে চারজনে বসে যাওয়া যেত যদিও রিজার্ভ ভাড়া একই কিন্তু ট্যাক্সির জন্য আগের রাতেই কন্টাক করে বুকিং দিতে হয়। আমাদের অত সময় ছিল না,তরও সইছিল না। আমরা ২৫০০ রুপিতে জিপ রিজার্ভ করলাম। জিপ ভাড়া করার সময় ড্রাইভারকে আগেই জানিয়েছিলাম, র্যাংপোতে গাড়ি থামানোর জন্য। তা না হলে এর জন্য অতিরিক্ত ভাড়া চাইবে।
একটা তিরিশে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। মনের মধ্যে মস্ত কোরাল খেলা করছিল,নতুন জায়গা, নতুন মানুষ,নতুন শহর আরও কত কী দেখার জন্য ফাল পারছিল।
শিলিগুড়ি থেকে সিকিম যাওয়ার সময় অনেকটা পথ তিস্তা নদীর পাশ দিয়ে যেতে হয়। রাস্তার একধারে উত্তুঙ্গ পর্বতশ্রেণি,সবুজাভ বনানীর সমাহার, আরেক পাশে খরস্রোতা তিস্তা। নদীর পানি স্বচ্ছ ফেনা তুলে বয়ে যাচ্ছে। কোথাও বাঁধ দেয়া পানি মুখ থমথম করে রেগে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড় যেমন আকর্ষণীয়, নদীও কম নয়। মন বলছে কোনদিকে তাকাই, একবার পাহাড় দেখি নদী ডাকে আয়। একবার নদী দেখি পাহাড় কাঁদে। মস্ত কোরালটা সুপ্ত কবিসত্তাকে জাগিয়ে তুলছে। এত যে আবেগআপ্লুত হয়ে পড়ছি তা প্রকাশের ভাষা নেই। ভালোলাগার এক হাত নিশপিশকরা অসহনীয় কষ্ট! মন বলছে-এক মুঠোয় সবুজ পাহাড় আরেক মুঠোয় নদী,
নদীতে চোখ পাহাড় কাঁদে পাহাড়ে চোখ কাঁদে জলধি।
কোনদিকে তাকাই বলো কোনখানে চোখ রাখি?
দুইই সমান সুখের আধার দুইই মায়াবী।
রাস্তার মোহমুগ্ধ বাঁক আর সুউচ্চ পথের অতলে বয়ে চলা চিত্তাকর্ষক নদী। আমরা বারবার ড্রাইভারকে গাড়ি থামাতে বলছি, ছবি তোলার জন্য। ড্রাইভার বলছে এখুনি? সামনে দেখলে আরও অবাক হবেন। সত্যিই তাই, যতই এগোচ্ছি ততই মুগ্ধতা বাড়ছে। রাস্তার সাত আটটি স্থানে ড্যাম নির্মাণ করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের ড্রাইভার ভাইটির নাম অশোক শর্মা। অশোক দাদা আমরা তিস্তায় টাফিং করব কি না জানতে চাইলেন। টাফিং মানে রাবারের বোটে চড়ে উজানের দিকে যাত্রা করা। ঠেউয়ের তালে তালে বোট এগোতে থাকে। লাইফ জ্যাকেট পরতে হয়। নদীর উজানে উঁচু নীচু স্থানে পাথরের সাথে ধাক্কা লেগে ছিটকে পড়লে বোটে একজন উদ্ধারকারী থাকে, সে বোটে তুলে নেয়। এভাবে টাফিং শেষে আবার জিপে তুলে দেয়। আমার ছেলেদের ভীষণ লোভ হচ্ছিল,আমারও। ওরা টাফিং করতে চাইল। জিওগ্রাফি চ্যানেলে বহুবার দেখেছে। অবশ্য আমিও দেখেছিলাম। কিন্তু টাফিংয়ে অনেক সময় ব্যয় হবে,গ্যাংটক পৌঁছাতেও দেরি হয়ে যাবে। তাই ছেলেদের বোঝালাম, ফিরার দিন টাফিং করো। ভারতের তিস্তা দেখে আমাদের তিস্তার জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে। যেমনটি আমার পেটের ছেলেটির একবেলা না খেয়ে থাকা শুকনো মুখ দেখলে হয়।
আমরা সিকিম যাওয়ার জন্য এপ্রিল মাস বেছে নিয়েছিলাম। মার্চ থেকে এপ্রিল উপযুক্ত সময়। ওখানে তখন বসন্তকাল। পরের মাসগুলোতে বরফ গলে যায় আর প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ধ্বস হয়। তবে শীত বা গ্রীষ্ম যখনই হোক গ্যাংটক(সিকিম) গেলে পর্যাপ্ত শীতের কাপড় নিয়ে যেতে হবে। এবং শিশুবাচ্চা থাকলে আলাদা সতর্কতা রাখতে হবে। আমরা সময়মত র্যাংপোতে পৌঁছালাম। ইতোমধ্যে অশোক দার সাথে দারুণ ভাব হয়েছে আমাদের। ওর র্যাংপোর রেজিস্ট্রেশন অফিসের লোকজনের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তাই র্যাংপোর ফরেইনার রেজিস্ট্রেশন অফিসে এন্ট্রি পারমিশনের ফরমালিটিস তাড়াতাড়ি সম্পন্ন হয়েছিল। তা না হলে দ্বিগুণ সময় লাগত। সবার এককপি করে ছবি,পাসপোর্ট ভিসার ফটোকপি জমা দিয়ে প্রবেশের একটি অনুমতিপত্র নিলাম। দার্জিলিং ভ্রমণে বলেছিলাম, যতদিন থাকবেন তারচেয়ে বেশিদিনের অনুমতি নেবেন, তাতে সুবিধা আছে। সিকিমে বাংলাদেশিদের যাওয়ার অনুমতি এতদিন ছিল না,দু’মাস হলো ভারত সরকার অনুমতি দিয়েছে। গ্যাংটকে গিয়েও বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থানে যাওয়ার অনুমতির জন্য আমরা প্রত্যেকের কয়েক কপি ছবি, পাসপোর্ট ভিসার ফটোকপি সঙ্গে নিয়েছিলাম। তবে কোন সরকারি কর্মকতার সিকিমে যাওয়ার পারমিশন ভারত সরকার দেয় না। আমরা অনুমতিপত্র নিয়ে সিকিম এলাকায় প্রবেশ করলাম। সকলের বুকের ভেতর মস্ত কোরাল আনন্দে দাপাদাপি শুরু করেছে।
হাতছানি দেয় শিবালিক :
অশোকদাদা তার হার্টেও ভাল্ব নষ্ট হয়ে যাওয়া স্ত্রীকে সময়মত দেবিশেঠীর কাছে নিয়ে যেতে পারেন নি। সেই অনুশোচনা তাকে কুঁরে খাচ্ছে। স্ত্রীহারা এই মানুষটি দশ বছর ধরে জিপ চালিয়ে ছয়জন সন্তান একাই মানুষ করছেন। এখন ছেলেরা বড় হয়েছে,তারাই রাঁধতে পারে। আগে সারাদিন গাড়ি চালানো শেষে বাড়ি ফিরেই রাতের খাবার রাঁধতে হত। শুনে খারাপ লাগছে মানুষটির জন্য। গ্যাংটকে প্রাইভেট গাড়িতে পৌঁছাতে চারঘন্টা সময় লাগে। তিন ঘন্টা যাওয়ার পর অশোকদা আমাদেরকে সবচেয়ে উঁচু পাহাড়টা দেখিয়ে বললেন,শিবালিক পাহাড়। আমরা ওই পাহাড়টায় যাব, ওটাই গ্যাংটক। ওর সবচেয়ে উঁচু স্থানে আছে এম জে মার্গ, অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধী মার্গ। প্রায় আট হাজার ফুট উঁচুতে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে অত উঁচুতে যাওয়া সম্ভব নয়, মেঘে আচ্ছন্ন হয়ে কেমন ঘনপীতবর্ণ হয়ে আছে। আনন্দ শিহরণের সাথে একটু ভয় ভয় যে লাগছে না তা নয়। রাস্তায় এত বাঁক,নিজে না দেখলে বিশ্বাস করানো যাবেনা। অশোকদা বললেন, কখন পৌঁছে যাবেন টেরই পাবেন না দিদি কারণ প্রতি মুহূর্তে উপরে উঠছেন।
হঠাৎ এক স্থানে গাড়ি থামালেন। আমরা চিন্তিত হয়ে বললাম,
: কী হয়েছে?
: নাহ, গাড়ির কিছু হয়নি। একটা বোতল থাকলে দেন দিদি।
দিলাম। রাস্তার বাম পাশে পাহাড় চুইয়ে ঝর্ণা নামছে। তারই একটি ধারায় বোতল ঠেকিয়ে পানি ভর্তি করে আনলেন। বললেন
: খেয়ে দেখেন, পৃথিবীর কোথাও এমন পানি পাবেন না।
খেতে ইচ্ছে করছিল না কারুর। তবু আমতা আমতা করে খেলাম। সত্যিই! এত সুমিষ্ট পানি খাইনি এর আগে। ধন্যবাদ জানালাম। অশোকদা বললেন
: কতজন নিয়ে যাই,গাড়ি থামাই না। দু’একটি পরিবার আপনাদের মত এমন অন্তরঙ্গ পাই, তাদেরকে এই পানি খাওয়াই।
এরপর কোথায় কোথায় কী কী সস্তা পাওয়া যায় কেনার মত সেগুলো দেখালেন।
ভ্রমণের পূর্বে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম। যেমন গ্যাংটকে এম জে মার্গের হোটেলগুলোতে থাকলে সুবিধা, তা না হলে এম জে মার্গ দেখতে যাওয়ার সময় পায়ে হেঁটে যেতে প্রচন্ড কষ্ট হবে। আর এম জে মার্গেও নীচের হোটেলগুলো সস্তা হলেও উন্নতমানের নয়। নির্ধারিত সময়ে পৌঁছে গেলাম। শরীরে যথেষ্ট ঠান্ডা লাগছিল। ঘন কুয়াশা আর মেঘের ছড়াছড়ির কারণে সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে। অশোকদা তার এক ঘনিষ্ঠ ড্রাইভারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, গোবিন্দলাল। আধা হিন্দি আধা বাংলায় কথা বলতে পারে। অশোকদার কাছে বিদায় নিয়ে গোবিন্দলালের ট্যাক্সিতে করে এম জে মার্গে পৌঁছালাম। হোটেল পাব কী না তাই নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলাম।
গোবিন্দ সাহায্য করছে, ইয়াং ছেলে, বয়স ২২/২৩ হবে, ভীষণ ভদ্র। আমরা উৎপলা নামে একটি হোটেল পেয়ে গেলাম এবং ম্যানেজারের বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। পুরোদস্তুর বাঙালি। উনার সাথে আমার ছোট ছেলের বেশ দাদু নাতির ভাব হয়ে গেল। গোবিন্দের মোবাইল নম্বর নিয়ে পরদিন শুধু গ্যাংটকের দর্শনীয় স্থানগুলো দেখার জন্য ওর গাড়ি ভাড়া করলাম, ২৫০০ রুপি। আমরা ফ্রেশ হয়ে শর্মা আর মম চা খেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরটি ঘুরে ফিরে দেখলাম। এখানে ধুমপান করলে,কাগজের টুকরো,চুইংগাম বা থুথু ফেললেই জরিমানা। রাস্তার মাঝখানে বসার ব্যবস্থা রডোডেনডনের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রকাশ্যে ধুমপান, মদ্যপান বা পান খাওয়া নিষিদ্ধ হলেও সিকিম ক্যাসিনো রয়েছে, কেউ ইচ্ছে করলে সেখানে যেতে পারে। এ রাজ্যটি পৃথিবীর সপ্তম কম জনবহুল এলাকা। সিকিমের অধিবাসীদের মধ্যে লেপচা এবং ভুটিয়ারা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী। ছেলে মেয়ে উভয়ের পোশাক প্রায় একই, শার্ট-প্যান্ট।
বাইচুং ভুটিয়ার দেশে মেঘ-ছায়ার লুকোচুরি :
মনেস্ট্রির ভেতরে কাঁচে ঘেরা অনিন্দ্যসুন্দর বুদ্ধ। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা পুরাণকথা আর ভাস্কর্যের ইতিহাস।
বিভিন্ন আকৃতির ঝর্ণা , নানা ধরনের গাছপালা,ফুলের সমাহারে মন প্রফুল্ল হয়ে উঠল। প্লান্ট কনসারভাটরি,রামটেক মনেস্ট্রি,গণেশটাক, ফাওয়ার শো,বোটানিক্যাল গার্ডেন,শান্তি ভিউ পয়েন্ট,ইঞ্চে মনেস্ট্রি,হনুমান টাক, রোপওয়ে,বনঝাকরি আর নীল ক্যানভাসে আঁকা তুষার ধবল শৃঙ্গরাজির সাথে মেঘের লুকোচুরি খেলায় বিমোহিত হচ্ছি ক্রমশ। গোবিন্দ পাকিয়ঙের সেন্ট জেভিয়ার্স বিদ্যালয়ের ছাত্র, ভারতের একসময়ের ফুটবল দলের অধিনায়ক বাইচুং ভুটিয়ার বাড়ি দেখিয়ে দিল। বাইচুংয়ের জন্ম সিকিমের টিনকিটাম। যে ১৯৯৬ সালে ইন্ডিয়ান প্লেয়ার অফ দ্যা ইয়ার নির্বাচিত হয়। বাইচুংয়ের শহরে ঘুরছি আমরা।
গ্যাংটকে পাথর বৃষ্টি :
দুপুরে লাঞ্চের জন্য একটা হোটেলে নামব এমন সময় হঠাৎ বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টির সাথে ঝরছে ইউরিয়া সারের মত চিকন সাদা বরফ পাথর, প্রচুর পরিমাণে। আমার ছোট ছেলে আহনাফ বারবার বৃষ্টির কাছাকাছি গিয়ে পাথর কুড়িয়ে আনছে। গোবিন্দ হেসে গড়াগড়ি, ওর কাছে যা স্বাভাবিক আমাদের কাছে আশ্চর্যের। বৃষ্টি থামলে রাস্তার পাশে পাশে জমে থাকা বরফ পাথর লম্বা ঢিপির তৈরি করেছে। তাই দেখে সম্রাট আর আদিব গাড়ি থামিয়ে লেন্স বন্দি করছে। তখনো সাঙ্গু আর ইয়ামথাং দেখা হয়নি। গোবিন্দ একটা সাদা শৃঙ্গ দেখিয়ে আধা বাংলায় বলল, কাল আমরা ওখানে যাবে। যদিও গোবিন্দের গাড়ি সাঙ্গু যেতে পারবে না। তবে সাঙ্গু যাওয়ার জন্য পারমিশনের কাগজপত্র, জিপ এবং একজন গাইড ঠিক করার সম্পূর্ণ দায়িত্ব তাকে দিয়ে আমরা একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।
নৈসর্গিক সাঙ্গুর আহবানে :
ভোরবেলা হোটেলের বারান্দা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কী অপরূপ দৃশ্য তা কেবল মনন দিয়ে অবলোকন করা যায়,লেন্স বন্দি করে বা ভাষার মাধ্যমে এই মোহমুগ্ধতাকে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। গোবিন্দ এসেছে বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে দিতে। এখানে দু’কদম হাঁটতে না চাইলে ট্যাক্সি নিতেই হবে। এসব রাস্তায় অন্য কোনো যানবাহন নেই। যত কাছেই যান না কেন ২০০ রুপি ভাড়া সর্বনিম্ন প্রায় বারো হাজার ফুট উঁচুতে যেতে হলে আপনি শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ কি না তা নিশ্চিত হতে হবে। সাইনাসের কারণে মাঝেমাঝে আমার শ্বাস কষ্ট হয়। তাই সঙ্গে ইনহেলার,নরসেল নিয়েছি। যাত্রা শুরু হলো, পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ। দূরের সেই ধবল পর্বতের উপরে চলমান গাড়িটার স্থানে একসময় আমাদের গাড়িও পৌঁছে যাচ্ছে, কী আশ্চর্য সুন্দর!। মধ্যপথে হোটেল রয়েছে, ঠান্ডার হ্যাভি জ্যাকেট,জুতো ভাড়া পাওয়া যায়। আমরা চারজোড়া বরফে হাঁটার জুতো নিলাম। হিমালয় পর্বতগুলোর উচ্চ শৃঙ্গের মাঝখানে রাস্তায় ঘুরে ঘুরে উপরে ওঠা মানেই সিকিমের সাঙ্গু। আলপাইন সৌন্দর্যের জন্য একে পূর্বের সুইজারল্যান্ড বলা হয়। কাছাকাছি গিয়েই বুঝতে পারলাম,তুষার ঝরতে শুরু করেছে। ওরহান পামুকের উপন্যাসের পটভূমির মত, ঝাপসা কাঁচের মত ভারী কুয়াশায় মোড়ানো শীতার্ত উপত্যকা।
আরও গভীরে যেতে বুঝতে পারলাম পথের দুই ধারে বরফের স্তুপ, মেঘছায়ার লুকোচুরি খেলা। নীল আকাশের বুকে সূর্যোদয়ের আলোকরশ্মির বিচ্ছুরণ, অজস্র হীরের মতন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যাওয়া দৃশ্যপট। বর্ণনাতীত এই সুন্দরের আস্বাদ গ্রহণের জন্য একমাত্র মননেরই দরকার,যা ভাষায় প্রকাশ আসলেই অসম্ভব। কেমন এক অচেনাকে চেনার সুখের অসুখ গ্রাস করেছে আমাদের। অসুখের ভেতর গলিতে হারিয়ে যাচ্ছি ক্রমশ। নৈ:শব্দ এসে হতভম্ব করে দিয়েছে মুখায়বয়ব। গন্তব্যে পৌঁছেছি, উঁচু নীচু চারিদিক ধবল বরফের কার্পেটে মোড়ানো, শাদা আর শাদা। নৈ:শব্দ ভেঙ্গে ছেলেরা হৈ হৈ করে উঠল, আমরাও স্নোফল আমাদের চোখ মুখ ভরে দিচ্ছে, বৃষ্টির মত গায়ে পড়ছে। আমরা আইসবল বানিয়ে একে অপরকে ছুঁড়ে মারছি। বরফে গড়াগড়ি, লুটোপুটি খেয়ে মনে হচ্ছে এত বয়সেও সেই ছোট্ট শিশুটি রয়ে গেছি, মনের ভেতরে কোরালটাও তাল দিচ্ছে তাথৈ তাথৈ। অনেকেই ইয়াকের পিঠে চড়ছে। আমাদের ইচ্ছে হয়নি। লম্বা লম্বা লোমগুলো কেমন নোংরা মনে হচ্ছিল। কেউ কেউ রোপওয়েতে চড়ছিল। প্রতিজন ২৫০ রুপি। আমরা সেদিন আর কোথাও গেলাম না। সাঙ্গুর রূপসৌন্দর্যে মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে রইলাম।
লাচোং, ইয়ামথাং ভ্যালির পথে :
সন্ধ্যায় গোবিন্দের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করে নিলাম লাচোং, ইয়ামথাং ভ্যালিতে যাওয়া সম্পর্কে। পরের দিন রওনা দিলাম। গ্যাংটক থেকে লাচোং এর দূরত্ব প্রায় ১২০ কিমি। পৌঁছাতে সময় লাগবে ৫-৬ ঘন্টা। লাচোং যাওয়ার সময় পথে কয়েকটি ঝর্ণা,লেক দেখে নিলাম। লাচোং এ গিয়ে তেমন মুগ্ধ হতে পারিনি। কেননা আবহাওয়া ছিল মাইনাস তিন ডিগ্রি সেলসিয়াস, অয়মিয়কনের কথা মনে পড়ছিল। সেখানে রাত কাটিয়ে পরের দিন জিরোপয়েন্টে গেলাম। এর ছয় কিমি পরেই ইয়ামথাং। ইয়ামথাং ভ্যালিতে লাচোং এর মত ঠান্ডা নেই। তবে ইয়ামথাঙের সৌন্দর্য প্রায় সাঙ্গুর মতই। তাই দ্বিতীয়বার সেই বর্ণনায় গেলাম না। দুদিনের ট্যুর শেষে ফিরে এলাম গ্যাংটকে।
অর্গানিক সিকিম :
ভারতের উত্তর পূর্বে অবস্থিত দ্বিতীয় ক্ষুদ্রতম রাজ্য সিকিম। ১৯৭৫ সালে ভারতের একটি অংশ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি প্রেমিকের এই স্বর্গের দক্ষিণ দিক ঘেরা আছে পশ্চিমবঙ্গ দ্বারা। দক্ষিণ পূর্বে ভুটান,পশ্চিমে নেপাল এবং উত্তর পূর্বদিকে চিনের স্বায়ত্তশাষিত অঞ্চল তিব্বত। পাহাড়, গভীর উপত্যকা আর জীববৈচিত্র্যে ভরা সিকিম পর্যটকদের কাছে ভীষণ পছন্দের একটি জায়গা।
পরিচ্ছন্ন এই রাজ্যে রয়েছে নারী পুরুষের অবাধ চলাফেরা। নারীরা স্বাধীনভাবে দোকানপাটে পসরা নিয়ে বসেছে। কেউ কাউকে বিরক্ত করছে না, বৈষম্যহীন পরিবেশ। ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রথম রাজ্য হিসেবে সিকিমকে রাসায়নিকমুক্ত বা অর্গানিক রাজ্য হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এমনই একটি অর্গানিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে দেখতে দেশে ফিরার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
ফিরে আসার পালা :
সিকিম থেকে রওয়ানা দিয়েছি। চার ঘন্টার পথ। ফিরে এসে দেখি মাত্রতো কয়েকদিন ছিলাম না দেশে। তাতেই দেখি অন্যরকম পরিবেশ! চারদিক পরিচ্ছন্ন, ঝকঝকে তকতকে। কেউ প্রকাশ্যে ধুমপান করছে না। নারীরা সাবলীলভাবে চলাফেরা করছে। মেল শভিনেস্টিক মানসিকতা নেই কারুর। কেউ রাস্তায় থুথু ফেলছে না। এমন পরিচ্ছন্ন পরিবেশে বুকের ভেতর মস্ত কোরালটা আমাদের সুখের হাওয়ায় দোলাচ্ছে যেন! এরই মধ্যে হঠাৎ আহাদের বেলুনে পিন ফোটালো এক বাঙালি। লোকটা রাস্তার ধারেই চেন খুলে উদোম স্থানেই বসে পড়ল পেচ্ছাব করতে। কী বিচ্ছিরি! পুরুষ কী না তাই নোংরামিতে ওস্তাদ। এটার লাইসেন্স জন্মাবার সাথে সাথেই পেয়ে গেছে। সামনেই,উল্টোমুখো দাঁড়িয়ে নারী গার্ড। লজ্জা পেয়েছে, এটাও যেন জন্মগত লাইসেন্স, লজ্জা পেতেই হবে। না হলে আবার নারী! হাহ! চিৎকার করে বরলাম,‘ শোনো, ওকে এরেস্ট করো। ও শহর নোংরা করছে।’ আবারো শরীরে ঝাঁকুনি, এবার ছোট ছেলে বলল,
: কী হয়েছে আম্মু? গোঙাচ্ছ কেনো?
: ওই লোকটা রাস্তা নোংরা করছে, দেখো।
: কই ? কেউ নেইতো। একপাশে পাহাড় অন্যপাশে তিস্তা।
বড় ছেলে বলল,
: তুমি কিছুক্ষণের জন্য ঝিমিয়ে পড়েছিলে। আবারও স্বপ্ন দেখেছ। এত স্বপ্ন দেখো কেনো আম্মু?
: তাইতো এত স্বপ্ন কেনো দেখি? স্বপ্ন দেখি বলেই আশায় বাঁচি বা বাঁচব বলেই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নটা অর্গানিক বলেই দেখি,আর চাই একদিন বাস্তবটাও অর্গানিক হোক, স্বপ্নের মত।